IQNA

মানব জাতির শ্রেষ্ঠ নেতা ও আদর্শ বিশ্বনবী (সা)

23:47 - November 06, 2018
সংবাদ: 2607141
ঘটনাবহুল,তরঙ্গায়িত ও বিপ্লবমুখর জীবনের অধিকারী বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড়, সফল ও প্রভাবশালী মহামানব। বিশ্বের সবচেয়ে অধঃপতিত ও পশ্চাতপদ সমাজ থেকে সবচেয়ে উন্নত সভ্যতার উন্মেষ ঘটানোর কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তিনি। এই মহামানবের ওফাত দিবস তথা ২৮শে সফর উপলক্ষে সবাইকে জানাচ্ছি গভীর শোক ও সমবেদনা।

মানব জাতির শ্রেষ্ঠ নেতা ও আদর্শ বিশ্বনবী (সা)বার্তা সংস্থা ইকনা: মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ রাসুল তথা সর্বকালের সেরা আদর্শের রূপকার এই মহামানবের জীবনের নানা দিক সম্পর্কিত আজকের এ আলোচনায় আপনাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আশা করছি 'মানব জাতির শ্রেষ্ঠ নেতা ও আদর্শ বিশ্বনবী(সা)' শীর্ষক এ আলোচনায় শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাব।

২৮ সফর ইতিহাসের সবচেয়ে শোকাবহ দিন। কারণ দশম হিজরির এই দিনে দুনিয়া থেকে বিদায় নেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব ও মানবজাতির মুক্তির শ্রেষ্ঠ দিশারী বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)। শুধু তাই নয় চল্লিশ বছর পর ৫০ হিজরির একই দিনে শাহাদত বরণ করেন মহানবীর প্রথম নাতি ও তাঁরই আদর্শের অন্যতম প্রধান সুরক্ষক হযরত ইমাম হাসান (আ)। চারিত্রিক মাধুর্য, নৈতিকতা, মানবীয় মূল্যবোধ, চিন্তাগত দূরদর্শিতা, রাজনৈতিক এবং আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক ও নৈতিক ক্ষেত্রসহ জীবনের সবক্ষেত্রে বিশ্বজনীন এবং শ্রেষ্ঠ খোদায়ি আদর্শের সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত ছিলেন মহানবী (সা)। তিনি ছিলেন শান্তি,সাম্য,ভ্রাতৃত্ব ও মানবীয় ঐক্যের শ্রেষ্ঠ রূপকার। মানবজাতির নৈতিক উন্নয়নসহ সার্বিক উন্নয়নকে পরিপূর্ণতা দিতেই ঘটেছিল তাঁর আবির্ভাব।

বিশ্বনবী (সা.)'র আবির্ভাব ঘটেছিল মানব জাতির এক চরম দুঃসময়ে যখন বিশ্বজুড়ে বিরাজ করছিল হানাহানি,জাতিগত সংঘাত,কুসংস্কার,অনাচার এবং জুলুম ও বৈষম্যের দৌরাত্ম্য। নারী জাতির ছিল না কোনো সম্মান। শির্ক ও কুফরির অন্ধকারে গোটা পৃথিবী হয়ে পড়েছিল আচ্ছন্ন। কিন্তু বিশ্বনবী (সা.) তাঁর শুভ জন্মের ৪০ বছর পর নবুওতি মিশন তথা ইসলামের বৈপ্লবিক নানা বাণী নিয়ে অজ্ঞ,কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং সব ধরনের উন্নত নৈতিক গুণ-বিবর্জিত মূর্তি পূজারী বর্বর আরব জাতির মধ্যে এমন পরিবর্তন সৃষ্টি করেন যে তারা মানব জাতিকে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও নৈতিকতাসহ নানা ক্ষেত্রে সবচেয়ে উন্নত সভ্যতা উপহার দিতে সক্ষম হয়।

ইসলামের দৃষ্টিতে মহান আল্লাহর পবিত্র অস্তিত্ব ছাড়া বিশ্বনবী (সা)’র চেয়ে বড় ও মহীয়ান আর কিছুই নেই। বিশ্বনবীর শ্রেষ্ঠ চরিত্র ও শ্রেষ্ঠ সংগ্রামী জীবন ছাড়া শ্রেষ্ঠ ধর্ম তথা শ্রেষ্ঠ খোদায়ী বিধান ইসলামের বাস্তবায়ন কল্পনাও করা যেত না। আর এ জন্যই বলা হয় বিশ্বনবী (সা) যখন রেসালাত পান তখন বড় শয়তান আর্তনাদ করে ওঠে এবং সব সহযোগী শয়তানদের জড়ো করে বলে যে, আমাদের কাজ তো কঠিন হয়ে গেলো!

পবিত্র কুরআনের ভাষায় জীবনে চলার পথ, মত ও স্বভাব বা আচরণের দিক থেকে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) ছিলেন শ্রেষ্ঠ আদর্শ বা উসওয়াতুন হাসানাহ। জীবনের সব ক্ষেত্রে এবং কখন কোথায় কী করতে হবে তা জানার শ্রেষ্ঠ উৎস হলেন মহানবী (সা)। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, আইনি ও রাষ্ট্রীয় জীবনসহ জীবনের সব ক্ষেত্রেই তিনি রেখে গেছেন মানবজাতির জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। কথায় ও কাজে সবক্ষেত্রে বিশ্বনবী (সা)-কে অনুসরণ করাই হবে একজন প্রকৃত মুসলমানের জন্য ঈমানের দাবি। তা না হলে আল্লাহর সর্বশেষ রাসুলের রেসালতের প্রতি বিশ্বাস রাখার দাবি করাটা হবে প্রতারণা মাত্র।

কেউ যদি মহান আল্লাহর প্রিয় বান্দাহ হতে চান তাহলে তাঁর জন্য পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত মহান আল্লাহর যে পরামর্শটি হৃদয়ে গেঁথে নেয়া উচিত তা হল: ‘হে রাসুল! আপনি তাদের বলুন, যদি আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমার তথা আল্লাহর শেষ রাসুলের অনুসরণ কর যাতে আল্লাহও তোমাদের ভালবাসেন।’

জীবনের সবক্ষেত্রেই মহানবীর (সা) অনুসরণ করতে মহান আল্লাহ মুসলমানদের নির্দেশ দিয়েছেন। মহানবী কেবল তাঁর বক্তব্যে নয়, আচার-আচরণে,জনগণের সঙ্গে মেলামেশায় ও লেনদেনে,পরিবার-পরিজন ও বন্ধুদের সঙ্গে আচরণে,শত্রু ও বিজাতীয়দের সঙ্গে আচরণে এবং দুর্বল ও দরিদ্র আর শক্তিশালী বা ধনীদের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রসহ সবক্ষেত্রেই সর্বোত্তম আদর্শ।

মহানবী (সা) চেয়েছিলেন তাঁর আশপাশের সব মানুষকে তাঁরই আদর্শের ধারায় শ্রেষ্ঠ বা পূর্ণাঙ্গ মহামানব হিসেবে গড়ে তুলতে। কিন্তু সবাই তাঁর দাওয়াতকে গ্রহণ করেনি। অনেকেই মুশরিক ও কাফিরই থেকে গেছেন। কেউ কেউ নামে মুসলমান হলেও বাস্তবে ছিলেন মুনাফিক। কিন্তু বিশ্বনবীর আহলে বাইতের সদস্যরা ছিলেন তাঁরই কাছাকাছি পর্যায়ের আদর্শ মহামানব যাঁদের নিষ্পাপ হওয়ার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে পবিত্র কুরআনেই।

তাই মহানবীর (সা) আদর্শ ও পবিত্র কুরআনকে ভালোভাবে বুঝতে হলে জানতে হবে পবিত্র আহলে বাইতের জীবন-ধারাকে। জানতে হবে কিভাবে মুসলমানদের মধ্যে প্রবেশ করেছিল নানা বিচ্যুতি, অনাচার, জুলুম ও ইয়াজিদি স্বৈরতন্ত্র, রাজতন্ত্র প্রভৃতি। বিশ্বনবীর আহলে বাইতের আদর্শকে ছেড়ে দেয়ার কারণেই যে মুসলমানদের মধ্যে নানা বিভক্তি এবং অনৈক্য সৃষ্টি হয়েছিল তাও বোঝা সম্ভব হবে ইসলামের ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে।

সুরা আহজাবের ৫৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,"আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দরুদ পাঠান। হে মুমিনগণ! তোমরা নবীর জন্যে রহমতের তরে দোয়া কর এবং তাঁর প্রতি সালাম পাঠাও।"

এ থেকে বোঝা যায় মহানবী (সা.) মানব জাতির জন্য মহান আল্লাহর সবচেয়ে বড় উপহার। নিরপেক্ষ বিশ্লেষণে অভ্যস্ত কোনো অমুসলিম পণ্ডিতও কখনও বিশ্বনবী (সা.)'র অতুল ব্যক্তিত্বের অনন্য প্রভাব,মহত্তম মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠ গুণগুলোর কথা অস্বীকার করতে সক্ষম নন। কারণ,মানব সভ্যতার সবচেয়ে সমৃদ্ধ পর্যায়গুলোর প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশ্বনবী (সা.)'র অতুলনীয় মহত্ত্ব ও গুণের ছাপ স্পষ্ট।

সুরা আহজাবের ৪৫ ও ৪৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,"হে নবী! আমি আপনাকে সাক্ষী,সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছি এবং আল্লাহর আদেশক্রমে তাঁর দিকে আহবায়ক ও উজ্জ্বল প্রদীপরূপে।"

বিশ্বের জাতিগুলো যখন নানা ধরনের মনগড়া খোদা বা মূর্তির পূজা করছিল এবং অজ্ঞতা,উদাসীনতা ও কুসংস্কার সর্বত্র জেঁকে বসে তখন মক্কা শহরে ইসলামের চির-উজ্জ্বল মশাল নিয়ে আবির্ভূত হন বিশ্বনবী (সা.)। তিনি মানবীয় মর্যাদা, মানবাধিকার ও স্বাধীনতার বিষয়ে উপহার দেন সবচেয়ে সুন্দর এবং সর্বোত্তম বক্তব্য। এভাবে তিনি মানবজাতির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষকের অক্ষয় আসনে সমাসীন হন।

বিশ্বনবীর(সা.) মধ্যে সব নবী-রাসূল ও আওলিয়ার গুণের সমাবেশ ঘটেছে, তিনি উচ্চতর সেইসব গুণাবলীর পরিপূর্ণ ও পরিপক্ক সংস্করণ-যেসব গুণ যুগে যুগে নবী-রাসূল ও আওলিয়ার মধ্যে দেখা গেছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ির ভাষায়, " যখন মহানবী (সা.)'র পবিত্র নাম মুখে আনি, এর অর্থ যেন হযরত ইব্রাহিম (আ.), নুহ (আ.), মুসা (আ.), হযরত ঈসা (আ.), হযরত লোকমান (আ.) এবং সব সালেহ বা সৎ ও খ্যাতনামা মহত ব্যক্তিদের ব্যক্তিত্ব বিশ্বনবী (সা.)'র মহান ব্যক্তিত্বের মধ্যে সমন্বিত,প্রতিফলিত ও প্রকাশিত হয়েছে।"

প্রখ্যাত ভারতীয় লেখিকা সরোজিনী নাইডু বিশ্বনবী (সাঃ)’র আদর্শ তথা ইসলাম সম্পর্কে দ্যা আইডিয়ালস অব ইসলাম গ্রন্থে লিখেছেন,

'ন্যায়বিচারবোধ ইসলামের এক অনুপম আদর্শ। যখনই আমি কোরআন অধ্যয়ন করেছি তখন প্রত্যক্ষ করেছি জীবন সম্পর্কিত সমস্ত গতিশীল নীতিকথা যা ভাববাদী অর্থে নয় বরং বাস্তব অর্থেই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের দৈনন্দিন জীবন পরিচালনার পথনির্দেশনা। '

বিশ্বনবী (সাঃ) মানুষের কাছে যে ধর্ম প্রচার করেছেন সে সম্পর্কে এ. জে. টয়েনবি লিখেছেন 'মুসলমানদের মধ্যে সংকীর্ণ জাতি বা গোত্রীয় চেতনার পরিপূর্ণ বিলোপ সাধন ইসলামের এক অবিসম্বাদী সাফল্য। বর্তমান বিশ্বকে গোষ্ঠী-প্রীতির অভিশাপ থেকে বাঁচানোর জন্যে ইসলামের প্রচার অত্যন্ত জরুরী।'

জর্জ বার্ণার্ড শ বিশ্বনবী (সা)’র অবদান ও আদর্শ সম্পর্কে 'দ্যা জেনুয়িন ইসলাম' গ্রন্থে লিখেছেন, 'ইসলামের মধ্যে যে অসামান্য জীবনী-শক্তি রয়েছে তার জন্যে আমি মুহাম্মদের ধর্মকে সব সময়ই প্রগাঢ় ভক্তি ও উচ্চ-সম্মান প্রদর্শন করে থাকি। আজ আমার কাছে স্পষ্ট যে একমাত্র ইসলামই পরিবর্তনশীল মানব-জীবনের সামগ্রীক অবস্থার সাথে খাপ-খাইয়ে নিতে সক্ষম,যার আবেদন সব যুগেই প্রযোজ্য ও অনুসরণীয়। অসাধারণ প্রজ্ঞাবান ও অত্যাশ্চার্য প্রতিভার অধিকারী এ মানুষ তথা মুহাম্মাদ (সা)কে যতটুকু আমি জেনেছি তাতে অকুন্ঠচিত্তে বলতে পারি,তিনি সমগ্র মানবজাতির ত্রাণকর্তা। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বর্তমান সময়ে যদি তাঁর মতো মহান ব্যক্তি পৃথিবী পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করতেন তবে তিনি মানব জাতির সেই কাঙ্ক্ষিত শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারতেন,আজকের দিনে যার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশী।'

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেনী (র) বলেছেন,

'মহানবীর আগমনের উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেয়া। তিনি মানুষের জন্য কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত করতেন ও তাদের সংশোধন করতেন এবং পবিত্র করতেন। তাদের আত্মাগুলোকে পবিত্র করতেন। মানুষের সুশিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য তিনি সবার চেয়ে বেশি কষ্ট করেছেন। আর তা করেছেন মজলুম মানুষকে জালিমদের হাত থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য। তাকে কত বেশি গালি দেয়া হয়েছে ও অপবাদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচারে বিরত হননি।'

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বিশ্বনবী (সা)’র আদর্শের প্রকৃত অনুসরণ সম্পর্কে বলেছেন,

‘মহানবীর রিসালাতের লক্ষ্য ছিল মানুষের মুক্তি সাধন। ইসলাম ও মহানবীর (সা) পক্ষ থেকে মানুষের জন্য রোগমুক্তির যে প্রেসক্রিপশন রয়ে গেছে তা সব যুগে মানুষকে মুক্ত করে অজ্ঞতা থেকে। এই নির্দেশিকা দিয়ে মোকাবেলা করা যায় জুলুম, বৈষম্য, দুর্বলের ওপর সবলের শোষণ এবং অন্য সব যন্ত্রণা যার শিকার মানবজাতি সৃষ্টির শুরু থেকে এ পর্যন্ত হয়েছে ও হচ্ছে। এই নির্দেশিকা যদি বাস্তবে মেনে চলা হয় তাহলেই সুফল আসবে। কিন্তু যদি ফেলে রাখা হয় বা এ থেকে ভুল অর্থ নেয়া হয়, কিংবা তা বাস্তবায়নের বা প্রয়োগের সাহস কেউ না করে তাহলে অবস্থা হবে সেই আগের মতই। সবচেয়ে ভালো ডাক্তারের শতকরা ১০০ ভাগ নির্ভুল চিকিৎসা-নির্দেশিকাও যদি আপনাকে দেয়া হয়, কিন্তু আপনি যদি তা পড়তে না পারেন, কিংবা তার ভুল পাঠ নেন, অথবা তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ না নেন ও তা পড়েই থাকে তাহলে রোগীর ওপর তার কী প্রভাব পড়বে! এবং ওই দক্ষ চিকিৎসককেই বা কি দোষ দেয়া যাবে?

মহানবী (সা.) জীবনের শেষ দিনগুলোতে অসুস্থাবস্থায় কখনো কখনো মসজিদে যেতেন এবং মুসল্লীদের সাথে নামায আদায় করতেন ও তাদেরকে কতিপয় বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতেন।

তাঁর অসুস্থতার কোন একদিন তিনি মসজিদে এসে ভাষণ শুরু করেন :“ হে লোকসকল! তোমাদের মধ্য থেকে আমার যাবার সময় চলে এসেছে। আমি যদি কাউকে কোন অঙ্গীকার করে থাকি, তা হলে তা পালন করতে আমি প্রস্তুত। আর আমার কাছে যদি কারো পাওনা থেকে থাকে, তা হলে সে যেন তা আমাকে বলে এবং আমি তা দেব।” ঐ সময় এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল :“ কিছু দিন আগে আপনি আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, আমি যদি বিয়ে করি, তা হলে আপনি আমাকে কিছু পরিমাণ অর্থ সাহায্য করবেন।” মহানবী (সা.) তৎক্ষণাৎ ফযলকে ঐ ব্যক্তির কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ অর্থ প্রদানের নির্দেশ দেন। এরপর মৃত্যুর তিন দিন আগে শুক্রবার মহানবী (সা.) মসজিদে এসে বললেন :“ আমার ওপর যদি কারো কোন হক বা অধিকার থেকে থাকে, তা হলে সে দাঁড়িয়ে তা প্রকাশ্যে ব্যক্ত করুক। কারণ এ পৃথিবীতে কিসাস বা প্রতিশোধ গ্রহণ আমার কাছে আখেরাতে কিসাস গ্রহণের চেয়ে বেশি প্রিয়।

এ সময় সাওয়াদাহ্ ইবনে কাইস দাঁড়িয়ে বলল :“ তায়েফের জিহাদ থেকে ফেরার পথে আপনি একটি উটের পিঠে সওয়ার ছিলেন। ঐ সময় আপনার হাতের চাবুক উটের উপর আঘাত করার জন্য উঠিয়েছিলেন, কিন্তু হঠাৎ করে আমার পেটে ঐ চাবুকের আঘাত লেগেছিল। আমি এখন আমার কিসাস নেয়ার জন্য প্রস্তুত।”

মহানবী (সা.)-এর আহবান নিছক ভদ্রতামূলক সৌজন্য ছিল না,বরং তিনি এমনকি এ ধরনের অধিকারগুলো,যা কখনো জনগণের মনোযোগ আকর্ষণ করে না৫৬৭ সেগুলো পর্যন্ত আদায় করার ক্ষেত্রে আন্তরিক ইচ্ছা পোষণ করতেন। মহানবী (সা.) তাঁর পরণের জামা উঠালেন যাতে করে সাওয়াদাহ্ তার কিসাস গ্রহণ করে। মহানবীর সাহাবীরা দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে ও অশ্রুসজল চোখে,কাঁধ প্রসারিত করে প্রতীক্ষা করছিলেন,এ ঘটনা কোথায় গিয়ে শেষ হয়! আসলেই কি সাওয়াদাহ্ প্রতিশো নেবে? হঠাৎ সবাই দেখতে পেল,সাওয়াদাহ্ অনিচ্ছাকৃতভাবে মন্ত্রমুগ্ধের মতো মহানবী (সা.)-এর পেট ও বক্ষদেশ চুম্বন করছে। এ সময় মহানবী (সা.) সাওয়াদার জন্য দুআ করে বললেন :“ হে আল্লাহ্! সাওয়াদাহ্ যেভাবে নবীকে ক্ষমা করে দিয়েছে সেভাবে তাকে আপনিও ক্ষমা করে দিন।

মহানবী (সা.)-এর অন্তিম ওসিয়ত

মহানবী (সা.) অসুস্থ থাকার দিনগুলোয় প্রয়োজনীয় বিষয়াদি স্মরণ করিয়ে দেয়ার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন এবং তাঁর অসুস্থতার শেষ দিনগুলোয় নামায এবং দাস-দাসীদের সাথে সদাচরণ করার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি নির্দেশ দিতেন এবং বলতেন :“ তোমরা দাস-দাসীদের সাথে সদাচরণ করবে, তাদের খাবার ও পোশাক-পরিচ্ছদের দিকে খেয়াল রাখবে, তাদের সাথে কোমল ভাষায় কথা বলবে এবং মানুষের সাথে সুন্দরভাবে মেলামেশা ও জীবন যাপন করবে।”

একদিন কা’ ব আল আহবার দ্বিতীয় খলীফাকে জিজ্ঞেস করলেন :“ মহানবী (সা.) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার অবস্থায় কী বলেছিলেন?” দ্বিতীয় খলীফা সভায় উপস্থিত আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর দিকে ইঙ্গিত করে বললেন :“ আপনি তাঁকে জিজ্ঞেস করুন।” আলী (আ.) বললেন :“ মহানবী (সা.)-এর মাথা যখন আমার কাঁধের উপর রাখা ছিল, তখন তিনি বলছিলেন: (الصّلوة الصّلوة ) নামায, নামায।” এ সময় কা’ ব বললেন :“ পূর্ববর্তী নবীগণও এ পদ্ধতির ওপর বহাল ছিলেন (অর্থাৎ তাঁরাও ওফাতকালে নামাযের ব্যাপারেই তাঁদের উম্মতকে নির্দেশ দিয়েছিলেন)।” ৫৭৩

জীবনের অন্তিম মুহূর্তগুলোয় মহনবী (সা.) চোখ খুলে বললেন :“ আমার ভাইকে ডাক যাতে সে এসে আমার শয্যার পাশে বসে।” সবাই বুঝতে পারলেন, তাঁর এ কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছেন আলী। আলী (আ.) তাঁর শয্যার পাশে এসে বসলেন। তিনি অনুভব করলেন, মহানবী (সা.) বিছানা থেকে উঠতে চাচ্ছেন। আলী (আ.) মহানবীকে বিছানা থেকে উঠালেন এবং নিজের বুকের সাথে তাঁকে হেলান দিয়ে ধরে রাখলেন।৫৭৪

আর ঠিক তখনই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার লক্ষণগুলো মহানবী (সা.)-এর পবিত্র দেহে প্রকাশ পেল। এক ব্যক্তি ইবনে আব্বাসকে জিজ্ঞেস করেছিল :“ মহানবী (সা.) কার বুকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন?” তখন ইবনে আব্বাস বলেছিলেন :“ মহানবী (সা.) আলীর কোলে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।” ঐ লোকটি আবার বলল :“ রাসুলের স্ত্রী আয়েশা দাবী করেন, মহানবী তাঁর বুকে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।” ইবনে আব্বাস আয়েশার কথা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন :“ মহানবী (সা.) হযরত আলীর কোলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। আর আলী ও আমার ভাই ফযল তাঁকে গোসল দিয়েছেন।”৫৭৫

আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) তাঁর এক ভাষণে এ বিষয় স্পষ্ট করে দিয়ে বলেছেন :

و لقد قُبض رسول الله و إنّ رأسه لعلي صدرى... و لقد ولّيت غسله و الملائكة أعوانِى

“মহানবী (সা.) আমার বুকে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন... আমি তাঁকে গোসল দিয়েছি এবং ঐ অবস্থায় ফেরেশতারা আমাকে সাহায্য করেছেন।”৫৭৬

কতিপয় মুহাদ্দিস বর্ণনা করেছেন, মহানবী (সা.) তাঁর জীবনের অন্তিম মুহূর্তে সর্বশেষ যে কথা বলেছিলেন, তা ছিলلا، مع الرّفيق الأعلي (না, বরং সবচেয়ে মহান বন্ধুর সাথে) যেন ওহীর ফেরেশতা তাঁর রূহ কবজ করার সময় তাঁকে রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করে এ পার্থিব জগতে প্রত্যাবর্তন বা ফেরেশতা কর্তৃক তাঁর রূহ কবজ করা ও অন্য জগতে (বারযাখে) দ্রুত চলে আসার মধ্যে যে কোন একটি বেছে নেয়ার এখতিয়ার দিলে তিনি এ বাক্য বলে ফেরেশতাকে জানিয়েছিলেন, তিনি মৃত্যুপরবর্তী জগতে চলে যেতে এবং সেখানে নিম্নোক্ত আয়াতে উল্লিখিত ব্যক্তিদের সাথে বসবাস করতে চান।

فأولئك مع الّذين أنعم الله عليهم من النّبيّين و الصّدّيقين و الشّهداء و الصّالحين و حسن أولئك رفيقا

“তাঁরা ঐ ব্যক্তিদের সাথে আছেন যাঁদের ওপর মহান আল্লাহ্ অনুগ্রহ করেছেন; আর এসব অনুগ্রহপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ হচ্ছেন নবী, পরম সত্যবাদী, শহীদ ও সৎকর্মশীল বান্দাগণ এবং তাঁরা কত (উত্তম) ভালো বন্ধু!” ৫৭৭

মহানবী (সা.) এ বাক্য বললেন এবং সাথে সাথে তাঁর দু’ চোখ ও ওষ্ঠ বন্ধ হয়ে গেল।৫৭৮

মহানবী (সা.)-এর ওফাত দিবস

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র মহান আত্মা ২৮ সফর সোমবার দুপুর বেলা চিরস্থায়ী আবাসস্থলের দিকে উড়ে যায়। তখন তাঁর পবিত্র দেহ একটি ইয়েমেনী চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়া হয় এবং অল্প সময়ের জন্য কক্ষের এক কোণে রেখে দেয়া হয়। মহানবী (সা.)-এর স্ত্রীগণের বিলাপ এবং নিকটাত্মীয়গণের ক্রন্দনধ্বনি শুনে বাইরে অবস্থানরত জনতা নিশ্চিত হন যে, মহানবী (সা.) ইন্তেকাল করেছেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই মহানবী (সা.)-এর ওফাতের সংবাদ সমগ্র মদীনা নগরীতে ছড়িয়ে পড়ে।

দ্বিতীয় খলীফা উমর কতিপয় কারণবশত ঘরের বাইরে চিৎকার করে বলেছিলেন :“ মহানবী (সা.) মৃত্যুবরণ করেন নি এবং তিনি মূসা (আ.)-এর মতো মহান আল্লাহর কাছে গেছেন” এবং এ ব্যাপারে তিনি মাত্রাতিরিক্ত তাকীদ দিতে লাগলেন এবং তিনি একদল জনতাকে তাঁর অভিমতের সমর্থকও প্রায় বানিয়ে ফেলেছিলেন। ইত্যবসরে মহানবী (সা.)-এর একদল সাহাবী৫৭৯ নিম্নোক্ত আয়াত হযরত উমরকে পাঠ করে শোনালেন৫৮০ :

و ما محمّد إلّا رسول قد خلت من قبله الرسل أفأن مات أو قُتل انقلبتم علي أعقابكم

“মুহাম্মদ কেবল আল্লাহর রাসূল; তাঁর আগে রাসূলগণ গত হয়ে গেছেন। যদি তিনি ইন্তেকাল করেন বা নিহত হন, তা হলে কি তোমরা তোমাদের পেছনে ফিরে যাবে?”

আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর পবিত্র দেহ মুবারক গোসল দেন এবং কাফন পরান। কারণ মহানবী (সা.) বলেছিলেন :“ আমার সবচেয়ে নিকটতম ব্যক্তি আমাকে গোসল দেবে।” ৮১ আর এ ব্যক্তি আলী ব্যতীত আর কেউ ছিলেন না। যা হোক,এরপর তিনি মহানবীর পবিত্র মুখমণ্ডল উন্মুক্ত করলেন। তখন তাঁর দু’ নয়ন বেয়ে প্লাবনের মতো অশ্রু ঝরছিল। তিনি তখন এ কথাসমূহ বলছিলেন :“ আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোন। আপনার ওফাতের মাধ্যমে নবুওয়াতের সূত্র ছিন্ন এবং মহান আল্লাহর ওহী ও আকাশের (ঊর্ধ্ব জগতের) খবরা-খবর বন্ধ হয়ে গেল, যা অন্য কারো মৃত্যুতে কখনো বন্ধ হয় নি। আপনি যদি আমাদের অপ্রীতিকর অবস্থায় ধৈর্যধারণ করার আহবান না জানাতেন, তা হলে আমি আপনার বিচ্ছেদে এতটা কাঁদতাম ও অশ্রু ঝরাতাম যে, এর ফলে আমি অশ্রুর উৎসই শুষ্ক করে ফেলতাম। তবে এ পথে আমাদের দুঃখ ও শোক সর্বদা বিদ্যমান থাকবে। আপনার পথে এ পরিমাণ শোক আসলে নগণ্য এবং এছাড়া আর কোন উপায়ও নেই। আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোন। আমাদেরকে আপনি পরলোকে স্মরণ করুন এবং স্মরণে রাখুন।” ৫৮২

সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি মহানবী (সা.)-এর জানাযার নামায আদায় করেন,তিনি আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)। অতঃপর মহানবী (সা.)-এর সাহাবীগণ দলে দলে এসে তাঁর জানাযার নামায আদায় করলেন। আর এ অনুষ্ঠান মঙ্গলবারের দুপুর পর্যন্ত চলতে থাকে। অতঃপর সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, মহানবী (সা.) যে কক্ষে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন, সেখানেই তাঁকে দাফন করা হবে। তাঁর কবর আবু উবাইদাহ্ ইবনে জাররাহ্ এবং যাইদ ইবনে সাহল প্রস্তুত করেছিলেন। হযরত আলী (আ.), ফযল ও আব্বাসের সহায়তায় রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর দাফন কাজ সম্পন্ন করেন।

পরিণামে,যে ব্যক্তিত্ব তাঁর নিরলস আত্মত্যাগের মাধ্যমে মানব জাতির ভাগ্যে পরিবর্তন এনেছিলেন এবং তাদের সামনে সভ্যতার এক নতুন ও উজ্জ্বল অধ্যায়ের অবতারণা করেছিলেন, তাঁর ইহজীবন-সূর্য অস্ত গেল। তাঁর ওফাতের সাথে সাথে তাঁর মহতী রিসালতী মিশন অব্যাহত রাখা এবং তাঁর মহান লক্ষ্য বাস্তবায়নের পথে অনেক বাধা ও সমস্যার উদ্ভব হয়, যেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রকট সমস্যা ছিল খিলাফত ও মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব বিষয়ক সমস্যা। মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের আগেই মুসলমানদের মধ্যে মতবিরোধ ও বিভক্তির লক্ষণগুলো স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের প্রতি আনুগত্য আর গভীর অনুরাগের উসিলায় পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার তৌফিক দান করুন। পার্সটুডে

captcha