IQNA

মুসলিম সভ্যতায় ভারতীয় প্রভাব

0:01 - June 17, 2022
সংবাদ: 3472000
তেহরান (ইকনা): ভারতবর্ষে দীর্ঘদিন অবস্থান, ভারতকে মাতৃভূমি হিসেবে গ্রহণ, স্থানীয় সভ্যতা-সংস্কৃতি ও বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর সাহচর্যে মুসলিম জীবনধারা ও সভ্যতায় যেসব প্রভাব পরিলক্ষিত হয় আধুনিক ও সর্বজনীন উর্দু ভাষা তার অন্যতম। যে ভাষায় আরবি, ফার্সি, তুর্কি ও সংস্কৃত ভাষার ঐশ্বর্য খুঁজে পাওয়া যায়। যে ভাষা নিজের উন্নত চিত্রকল্প, মিষ্ট ও নান্দনিকায় অনন্য।
অভিজাত ও শহরবাসীর পোশাক-পরিচ্ছদ। যা ভারতেই সৃষ্টি। উন্নত রুচি ও জীবনধারার উত্তম দৃষ্টান্ত। এমনকি দিল্লি, লখনউ, হায়দরাবাদসহ ভারতের প্রধান প্রধান নগরগুলোতে মোগল আমলের শেষভাগে যে জীবনধারা ও সংস্কৃতির সূচনা হয়েছিল তাও স্থানীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিরই প্রভাব। যার পরতে পরতে মেধা, প্রতিভা, উন্নত রুচি, শিল্পবোধ ও মার্জিত গুণাবলি লক্ষ করা যায়।
মা-বাবার প্রতি অতিরিক্ত সম্মান, তাদের সামনে লজ্জা ও শালীনতার বিশেষ রীতি, পর্দার প্রতি নারীদের কঠোর মনোভাব এবং তাদের জীবনযাপনের বিশেষ রীতি—এগুলো এমন বৈশিষ্ট্য, যা অন্যান্য দেশের বেশির ভাগ মুসলিমের ভেতর দেখা যায় না। এসব বিষয়ে ভারতীয় মুসলিমদের বিশেষ অবস্থা, শাসক শ্রেণির কল্যাণকামিতা ও প্রাচীন সামাজিক কাঠামোর বিশেষ প্রভাব আছে। সব সময় সমপর্যায়ের পরিবার ও বংশের সঙ্গে সম্পর্ক করা, নিজের বংশের রীতি-নীতি ও মানদণ্ডের বাইরে না যাওয়া ভারতীয় মুসলিম সভ্যতার বিশেষত্ব, যাতে ভারতীয় বংশচিন্তা ও গোষ্ঠীপ্রীতির স্থায়ী প্রভাব আছে। ভারতবর্ষ ছাড়া পৃথিবীর অন্য অঞ্চলের মুসলিমরা সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শুধু আভিজাত্য ও অবস্থানের বিবেচনা করে। তারা একই গোত্রে বিয়ে করাকে শুধু অপছন্দ করে না, বরং তা শুনলে বিস্মিত হয়। স্বগোত্রে বিয়ে করা ভারতীয় মুসলমানের বৈশিষ্ট্য। বিয়ে ও মৃত্যুসহ অন্যান্য সামাজিক আচারে এতটা গুরুত্ব দেওয়া, তাতে নিজের সামর্থ্যের চেয়ে বেশি খরচ করা, আড়ম্বরপূর্ণভাবে উদযাপন করা ভারতীয় সভ্যতা ও জীবনধারার বৈশিষ্ট্য, যা এই অঞ্চলের মুসলিমদের প্রভাবিত করেছে। নতুবা ইসলাম এসব বিষয়ে অনাড়ম্বর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।
 
এমনিভাবে মালিক ও ভৃত্যের এতটা দূরত্ব সৃষ্টি করা যেন তারা দুই প্রজাতির প্রাণী। কখনো কখনো তাদের সঙ্গে অচ্ছুতের মতো আচরণ করা হয়। এগুলো ভারতে ইসলামী শাসনের পতনকালের স্মারক, জমিদারি যুগের ঐতিহ্য এবং মুসলিম সমাজে অন্য সভ্যতার প্রভাবের ফলাফল। একইভাবে পেশার ভিত্তিতে সামাজিক মর্যাদায় তারতম্য করাও ভারতীয় ঐতিহ্যের অংশ। ভারতের মাটি এবং তার সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ভারতীয় মুসলিমদের বহু মূল্যবান উপহারে সমৃদ্ধ করেছে, যা ভারতীয় ইসলামী সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং গৌরবময় স্বত্বাধিকার। যার বদৌলতে ভারতীয় মুসলিমরা পশ্চিমা সভ্যতার প্রভাব ও ভয়াবহ আক্রমণ এমন সাফল্য ও সামর্থ্যের সঙ্গে মোকাবেলা করতে পেরেছে। তারা তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তিত্বকে এমনভাবে রক্ষা করেছে, যার দৃষ্টান্ত অন্যান্য মুসলিম দেশে দেখা যায় না। ভারতীয় মুসলিমদের চিন্তার গভীরতা ও দূরদর্শিতা, তাদের আধ্যাত্মিক সাধনা ভারতের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, মতাদর্শ ও সামাজিক আন্দোলনের ফসল, যা এই দেশে বিগত শতাব্দীগুলো সক্রিয় ছিল। যা নতুনভাবে ভারতীয় ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির ভিত্তি দান করেছে এবং তাকে এমন অবয়ব দান করেছে যে তাতে একই সঙ্গে ইসলামের বহুজাতিক সংস্কৃতি ও স্থানীয় সভ্যতা-দর্শনের প্রতিবিম্ব দেখা যায়।
 
সঙ্গে সঙ্গে ইসলামী চিন্তাধারা ও নৈতিক মূল্যবোধেও পরিবর্তন এসেছে। যদিও তা ভারতের আগমনকারী ও অন্যান্য বিজয়ী জাতিগুলোর তুলনায় খুব সামান্য। ভারতের মাটিতে এসব জাতি ও সভ্যতার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। কিন্তু মুসলিমরা তাদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে পেরেছে। তবু মুসলিম শাসনের শেষভাগের একজন অনুভূতিশীল  হৃদয়বান মুসলিম কবি খাজা আলতাফ হুসাইন এই ব্যাপারে অভিযোগ পেশ করেছেন।
 
বাস্তবতা হলো কোনো সভ্যতা শুধু অপর সভ্যতাকে প্রভাবিত করবে, কিন্তু নিজে প্রভাবিত হবে না—এটা মানব ইতিহাসে বিরল ঘটনা। এটা না মানবপ্রকৃতির অনুকূল, না তার জন্য কল্যাণকর। মানবজীবনে আদান-প্রদানের অভিজাত ধারা প্রবহমান। আর এর ভেতরেই নিহিত আছে তার উন্নতি ও অগ্রযাত্রা, তার বিকাশ ও পরিবর্তনের রহস্য।
 
তামিরে হায়াত থেকে
 
মো. আবদুল মজিদ মোল্লার ভাষান্তর
captcha